Looking For Anything Specific?

ads header

ভয়নিচ পাণ্ডুলিপিতে কি লেখা আছে? এর লেখকই বা কে?(ভয়নিচ পাণ্ডুলিপি পর্ব ০৩)


ভয়নিচ পাণ্ডুলিপির লেখাগুলো কেউ পড়তে পারেনা। কারণ, এই লেখাগুলোর মধ্যে যেসব বর্ণ ব্যাবহার করা হয়েছে, তা কোন ভাষার কেউ জানে না। তাই ভয়নিচ পাণ্ডুলিপির মূল রহস্য এই বইয়ের প্রতিটি পাতায় লেখা বর্ণগুলো। এক অজানা ভাষায় লেখা হয়েছিল এই পুরো বইটি। কিন্তু, কোন সে অজানা ভাষা, তা আজ পর্যন্ত কেউই বলতে পারেনি। পৃথিবীর ইতিহাসে এই বইয়ের বর্ণমালার মতো কোনো বর্ণমালার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই আজকের পর্বে আমরা এই বইয়ের বর্ণমালা, ভাষা এবং চিত্র নিয়ে আলোচনা করব। সাথে আরও আলোচনা করব, এই বইয়ের লেখক সম্পর্কে।

তবে শুরু করার আগে বলে দিই, আমি এর আগের পর্বগুলোতে বলেছিলাম এই বইটি আসলে কি জিনিস? এই বই নিয়ে কি কি গবেষণা হয়েছে? কীভাবে এই বইটি জনসম্মুখে এলো? কে এই বইটাকে জনসম্মুখে নিয়ে এলো? তো যারা এর আগের পর্বগুলো পড়নি, তারা অবশ্যই আগের পর্বগুলো পড়ে আসো। তোমাদের সুবিধার্থে আমি আগের পর্বগুলোর লিংক নিচে দিয়ে দিচ্ছি।

তো চল এই বইটি শুরু থেকে পাঠ করা শুরু করি।

প্রতিটি পৃষ্ঠায় ২/৩টি করে অনুচ্ছেদ পাওয়া যায়। এখানকার বর্ণমালাগুলো দেখলে সবাই মনে করে, এগুলো আসলে কোনো বর্ণমালা নয়। এগুলো হচ্ছে কতোগুলো সাংকেতিক চিহ্ন। কয়েক পৃষ্ঠার পর তোমরা দেখতে পাবে এই বইয়ের মধ্যে বিভিন্ন চিত্র আঁকা আছে। সবই হাতে আঁকা ছবি। এসব ছবি দেখে তোমাদের মনে হতে পারে, এটা হয়তো কোনো বিজ্ঞানীর নোটখাতা। কিন্তু তোমাদের মনে হওয়াকে ভুল প্রমাণিত করবে এই বই। কয়েক পৃষ্ঠা আরও উল্টালে তোমরা দেখতে পাবে জ্যোতিষীর ভাগ্য গণনার ছক। তোমাদের তখন মনে হতে পারে এই বইটি আসলে জ্যোতিষীর ভাগ্যগণনার সহায়িকা। কিন্তু পরের পাতাগুলোতে আবার বৃত্ত, ত্রিভুজ ইত্যাদি দেখতে পাবে। ফলে যতই পাতা উল্টাবে, ততই তোমরা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকবে। একের পর এক রহস্য যেন তোমাদেরকে গ্রাস করে ফেলবে। এই বইয়ের যতই গভীরে যাবে, ততই তোমরা রহস্যের মায়াজালে আটকে পড়বে। 

এই বইয়ে জ্যামিতির প্রমাণও পাওয়া গেছে। কিছু কিছু পাতায় বৃত্ত, ত্রিভুজ, অর্ধবৃত্ত ইত্যাদি জ্যামিতিক নকশা আঁকানো আছে। সাথে ছোট ছোট অক্ষরে কিছু বাক্য এসব চিত্রের সাথে যুক্ত করা ছিল। শেষের দিকে যেসব পৃষ্ঠা আছে, তাতে বেশ কিছু বাক্য দেখা যায়, যেগুলো লম্বভাবে লেখা হয়েছে। বাক্যগুলো দেখতে অনেকটা জাপানীদের মতোই দেখায়। সম্প্রতি ভাষাবিদরা গবেষণা করে দেখতে পান, এই বইটির বেশকিছু বর্ণে গ্রিক বর্ণমালার ছাপ রয়েছে।

তবে বেশিরভাগ বর্ণমালা দেখতে কিসের মতো জানো? বেশিরভাগ বর্ণমালায় যেটা লক্ষ করা গেছে, তা হলোঃ বর্ণমালাগুলো, প্রাচীন রসায়নবিদদের ব্যবহৃত বিভিন্ন চিহ্নের মতো দেখতে। আরও একটা জিনিস এই পাণ্ডুলিপিতে দেখা গেছে।

প্রাচীনকালের যেসব পাণ্ডুলিপি পাওয়া গেছে, তাদের মধ্যে প্রায়ই বাক্য ভুল থাকতো। পরে সেই ভুলগুলো কেটে সংশোধন করা হতো। সেগুলোর নমুনাও পাওয়া গেছে। কিন্তু এই বইটিতে ভুলের কারণে কোথাও কাটাকাটি নেই। তাই এই রহস্যময় বইটিতে ভুলের সংখ্যা শুন্য। কারণ যিনি এই বইয়ের লেখক, তিনি কোনো বাক্য সংশোধন করেন নি। কোনো বাক্য ভুল গেছে কিনা তা হয়তো তিনি লক্ষই করেন নি, অথবা তাঁর কোনো বাক্যই ভুল ছিল না। তাই তো তিনি তাঁর লেখায় কোনো বাক্য কাটাকাটি করেননি।

বিভিন্ন রঙের কালি ব্যবহৃত হয়েছে এই বইটি লেখতে। পুরো বইয়ে বর্ণমালার সংখ্যা কত, জানো? প্রায় ১৭ হাজার। শুধু এই সংখ্যাটুকুই একজন গবেষকের রাতের ঘুম নষ্ট করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট! বর্ণমালাগুলোর মোট সংখ্যা ১৭ হাজার হলে, এসব বর্ণ একজন মানুষকে শিখতে কত বছর লাগতে পারে!

চল এরপর আমরা আরও কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। ছবি নিয়ে আলোচনা করা যাক। এই বইয়ের ভিতরে পাতা, ফুল, ফল, চিহ্ন, ইত্যাদি ছবির খোঁজ পাওয়া গেছে। এই ছবিগুলোকে গবেষকেরা ৭ ভাগে ভাগ করেছেন। নিচে এই ভাগগুলো দেওয়া হলোঃ

১। জীবজগৎ

২। মহাজাগতিক বস্তু

৩। জ্যোতির্বিদ্যা

৪। চিকিৎসা

৫। ভেষজ

৬। রাশিচক্র

৭। সাংকেতিক চিহ্ন 

এসব বিষয়ের সাথে বইটির বিভিন্ন ছবির মিল পাওয়া গেছে বলে গবেষকেরা মনে করেন। এর মধ্যে অবাক করা ব্যাপারও আছে। এই বইয়ের কিছু চিত্রে চীনা পৌরাণিক প্রাণী ড্রাগনের ছবিও পাওয়া গেছে। কিছু কিছু ছবির সাথে ছবির বর্ণনাও দেওয়া হয়েছে। 

যেহেতু এই বইটিতে রহস্যের কূলকিনারা করার কোনো আশানুরূপ ফল খুঁজে পাননি কেউ, তাই কয়েকজন বিজ্ঞানী পুরো বইটাকে বানোয়াট বলে দাবি করেন। অনেকের মতে এটি ভয়নিচ তামাশা করে অর্থ লাভের আশায় বানিয়েছে। কিন্তু তাঁদের এই ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেন “গর্ডন রাগ”। তিনি লন্ডনের কিলি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গনিতবিদ।

গর্ডন রাগ ভয়নিচ পাণ্ডুলিপির মতো করে আরেকটি সাংকেতিক ভাষা তৈরি করেন। পরে সে অনুযায়ী বাক্যও রচনা করেন। তিনি এভাবে দেখান যে, ভয়নিচ পাণ্ডুলিপিও হয়তো এরকমই কোনো তৈরিকৃত ভাষা দিয়ে লেখা হয়েছে। তাই এটি ভুয়া হতে পারেনা। তিনি গানিতিক উপায়ে এটির প্রমাণও করেন। তাই অনেক গবেষক তাঁর থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে এখনো এই বইয়ের রহস্য ভেদ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

এবার চল জেনে নিই এই বইয়ের লেখক কে?

অনেকেই মনে করেন যে, এই বইটি একটি বানোয়াট বই। ভয়নিচ অর্থ লাভের জন্য তামাশা করে এই বইটি তৈরি করেছেন। কিন্তু উপরেই বলে দিয়েছি, এই বইটি বানোয়াট নয়। গর্ডন রাগ সেটা প্রমাণও করে দিয়েছেন। তাই এই ধারণা, তথা বানোয়াট বইয়ের ধারণাটা ভুল।

এরপরে আরেকটি ধারণা পাওয়া যায়। ভয়নিচ পাণ্ডুলিপির ভিতরে থাকা চিঠিতে বিজ্ঞানী জোয়ানাস মার্সি লেখেন যে এই বইটি হয়তো রজার বেকন কর্তৃক লেখা হতে পারে। এই ব্যাপারে ভয়নিচ, যিনি এই বইটি জনসম্মুখে নিয়ে আসেন, তিনি একমত ছিলেন। বিজ্ঞানী জোয়ানাসের মতে, রজার বেকনের একজন ব্যক্তিগত নথিপত্রের দায়িত্বে ছিলেন। সেই লোকটির নাম ছিল জন ডি। এই জন ডি রাজা দ্বিতীয় রুডলফের দরবারে নিয়মিত আসা-যাওয়া করত। তাই সেই হয়তো এই বইখানা রজার বেকনের কাছ থেকে নিয়ে রাজার দরবারে বিক্রি করেছিল।

ভয়নিচের জীবদ্দশায় সবাই এটি বিশ্বাস করত। কিন্তু ভয়নিচ মারা যাওয়ার পর সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। এসময়ে টিস্যু বিশেষজ্ঞ এরউইন পেনফস্কি এই বইয়ের পৃষ্ঠা পরীক্ষা করেন। পরীক্ষার পর জানতে পারেন যে, এ ধরণের পৃষ্ঠা ব্যবহার শুরু হওয়ার আগেই রজার বেকন মৃত্যুবরণ করেন। তাই তিনি এই বইটির লেখক হতেই পারেন না।

এ বিষয়ে আরও একটি মতবাদ আছে, যা অনেক বেশী যুক্তিনির্ভর। অনেক গবেষক মনে করেন যে, মার্সির ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাফায়েল নিশোভস্কি এই বইয়ের লেখক। কিন্তু কি কারণে তাঁরা এটি মনে করেন? এর কারণ, রাফায়েল তাঁর জীবদ্দশায় একবার দাবি করেন যে, তিনি এমন এক সাংকেতিক ভাষা আবিষ্কার করেছেন, যা কখনোই কেউ বুঝতে পারবে না। কথিত আছে, বইয়ের লেখক যে রজার বেকন, তা মার্সির কাছে তিনিই প্রথম তুলে ধরেন। হয়তো তিনি তাঁর আবিষ্কারকে বিশ্বাসযোগ্য আর রহস্যময় করে তুলতে এই বিষয়টি গোপন রেখেছিলেন। এই যুক্তির উপর বিশ্বাস করে অনেক গবেষক রাফায়েল নিশোভস্কিকে এই বইয়ের লেখক হিসেবেই তুলে ধরেন।

তবে এই বইয়ের প্রকৃত লেখক যে কে, তা কেউ নিশ্চিতভাবে বলতেই পারে না। লেখকের ইতিহাস বের করা তো দূরের কথা, এই বইয়ের লেখাগুলো তো কেউ পড়তেই পারে না। যদি পড়া যেত, তবে লেখককে চেনা সহজ হতো। যেহেতু পড়ারই কোনো সিস্টেম নেই, তাই এই বই যে কি বিষয়ে লেখা হয়েছে, তা জানাও যায় না। ফলে পৃথিবীর ইতিহাসে এই “ভয়নিচ পাণ্ডুলিপি” একটি অজানা রহস্যে ঘেরা, অমীমাংসিত বই হিসেবে রয়ে গেছে, যে বই কেউ পড়তে পারে না।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ